Jan 26, 2008

ঝরাপাতা গো

মরণ-সুতোয় গাঁথল কে মোর বরণমালা।
...অচিন দেশে এবার আমার যাবার পালা॥
ওয়াহিদুল হক অভিধানতুল্যপ্রজ্ঞাবানেষু--


শুকনো পাতারও একটা ভাষা আছে বেদনাভাবক, ’৩৪-এ গুরুদেবের এ কথন ধৃত হওয়া থেকে শুরু করে এ যাবৎ যতজনই সে ভাষা শুনতে চেয়ে পেতেছেন কান, কমবেশি সবারই মন ছিল দূরে, সকলেই ভেবেছেন স্বভাবত, এ ভাষাও শ্রুত হবে কানে, রোরুদ্য হামলে পড়ে পৌঁছে যাবে মস্তিষ্কে আকুতি

এই শ্রুতি মননের কাজ, সর্বতোভাবে, রানী চন্দ জেনেছেন আগে, সখাকুল সমভিব্যাহারে

জাগ্রত মনস্কামনাপুচ্ছ খসে যায়, একে একে গুরুভাগ ঝরে, হারায় লিরিকখানি তালে-লয়ে মিলবারও আগে

আনাচ-কানাচবাসী বেদনাপ্রকাশ ঘটে চিরকালই কম, কমই এরা নীরব বোধিতে আসে সুদূরবাসীর, কমই হন এরকম অন্তঃকর্ণধারী

কেবল গুটিকয়জনই শুকনো পাতার ভাষা বোঝেন, গুটিকয় ওরকমজনই

আমি ও অ্যারিস্টটল

‘কবিদের বিষয়ে’ নামে প্রথম গ্রন্থটি লিখেছিলেন ম্যাসিডোনিয়ার রাজপ্রাসাদে বসে ভাববাদী অ্যারিস্টটল, হঠাৎ যা হারিয়ে গিয়েছিল আমার তৃণগুল্মময় আরণ্যমাথায়, হাজার আড়াই বছরেরও পরে, আদ্যন্ত ওটা কুড়িয়ে এনেছি শুধু তোমাদের কথা ভেবে, জেনেছি তোমরা অধীর হয়েছ বেশ, জানতে পেরেছ বলে টিকে থাকা ‘পোয়েটিকস’ হলো মহা-অনুকার্যকলা, আর ‘কবিদের বিষয়ে’ ছিল তারও আগে জ্বলা চূড়ান্ত আলো

এবার আমি লিখছি চেনা বাংলা হরফে, বস্তুবাদীজন, মনে রেখো, ভাস্কোদাগামার সাথে ভারত কিংবা কলম্বাসের সাথে আমেরিকার যেমনটি যোগ, আমার সাথে ‘কবিদের বিষয়ে’রও তেমনি, তুলে আনছি সৃজন-শোভন করে, গড়েপিটে নিতে এক প্রত্নকলাবোধ-- ভেবো কবিতা করার বেলা, যে, সেটা কল্পরঙিন ছায়া, আনন্দ ও অধ্যাস, মঙ্গল ও বেদনা, জীবন ও মিথ্যা এবং মৃত্যু ও সত্যের পরমতাকে ছোঁয়া

পড়ো-- প্লেটো, গুরু মহামহিমের নামে, তর্কে তর্কে যার, এ যাবৎ পৃথিবীতে বহু গলেছে বরফ, বলেছেন এ-ও-- ‘কাব্যকে রাষ্ট্রে স্থান দেয়া গেলে আখেরে হতে পারে সবিশেষ লাভই’, কারণ সুমহান হোমারের তিনি অনুরক্ত ছিলেন, কারণ সক্রেটিসের মৃত্যু তাঁকে ব্যথিত করেছিল

জলসিন্দুকের চাবি

কোটিকাল স্তব্ধ ছিল জলের সিন্দুক, হাট হয়ে খুলে গেল গোপন দরজা, চমকালো যে ছিল যেখানে লঘু মৎস্যকন্যারা, কালে কালে বিদ্রোহ সংবাদে যেভাবে চমকে ওঠে গণবিমুখ সব রাষ্ট্রসংঘ

নাচুনে বাতাসেরা জলময় শুয়ে গেলে জলের শরীরে আসে যৌবন, পঞ্জরাস্থি জেগেওঠা হাঁপানি রোগীর মতো আমাদের বোবা-কালা নদীদের বুকে জাগে কুলুকুলু ধ্বনি, বহুক্রোশ দূর থেকে গয়নানৌকায় চড়ে বেড়াতে আসে চাঁদবউ, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে তার নিশাচর আশাপক্ষীদল, বেধড়ক আলিঙ্গন চেয়ে তারা বাতাসের বস্ত্র ধরে টানাটানি জুড়ে, বলে হবেই হবে

নিচে অদূর অতলে বাজে আদিমান রত্নবেরাদর, তন্দ্রাচ্যুতরা উঠে আনন্দে নেচে বসে লাঞ্ছিত সমীর সকাশে, আসে প্রত্নবিদেরা, আসে সোনারুরা, কাদামাখা ইতিহাসবিদ, তারপর রাতারাতি জাদুঘর

এই যে আমরা, কামনালিপ্তরা, বহুরূপ জাদুঘর ঘুরেছি জীবনে, কর্মের চেয়ে বেশি মুখচ্ছবির প্রতি দেখেছি অকারণ ঝোঁক, মানুষের চেয়ে তার ব্যবহার্যের প্রতি-- এরূপ ঘষাখাওয়া রুচির লক্ষণা-ব্যঞ্জনা দেখে আমরা ঠাহর করি, নিখিলবিশ্বে বুঝি মিথ্যার অধিক কোনো প্রকৃত জাদু নেই

চাবিতর্কে জানা যায়, মাছশিকারিরাই জোসে সাজিয়ে রাখে এই গোপনায়োজন, এরকম গ্যাঁড়াকল ফেঁদে কোথায় কাদের লাভ, কোথায়-যে লোকসান, বুঝেও বুঝি না, এ তথ্য জ্ঞাত হতে আমরা সেবার দলে পুরো শীত কাটিয়েছি শীতলক্ষ্যাতে আর জরিপ করেছি জল নিদারুণ অলীক খায়েশে

জলযাত্রা

ভোরের বৃষ্টি ধুয়ে দিয়ে গেল গত দিনের ধুলো, গাছপালা সড়ক ও জনপথ, প্রাতস্নানা এই শিশু দিনটিকে পকেটে গুটিয়ে নেই রুমালের মতো, আমার তো যেতে হবে দূর-বহুদূরে

শহরের ভেজা সব কাকেদেরও আগে, নিজস্ব পাখা নেড়ে হোগলাবনের ভিড়ে, মাসকাটা-লতা বেয়ে আমাদের লঞ্চ যাবে পাতাদের হাট, সুপারিবনের বেশ গভীরপুরীতে, তার টংঘরে, কয়েকটি চাঁদরাত চেখে যেতে চাই আমি পুঁথি আর সুরে সুরে লোককবিতার

মাঝপথে তড়িঘড়ি রুমাল পরশে আমি মুছে নেই পিচুটি কান্তির, তারপর দিনকে আদর দিয়ে পৌঁছে দেই অন্ধকার রাত্রিসদরে

দিন ও রাত্রির এক চিরকেলে গোধূলিমোহনায় দেখি নাতিদীর্ঘ এবারের এ জলযাত্রায়, আকাশ চলেছে তার গনাগোষ্ঠীসহ

ভ্রমণে পাওয়া জলস্তোত্র

ক্ষমতা ও অক্ষমতার কণ্ঠস্বরের পার্থক্যটি নদী ও পুকুরের মতো, একটি উন্মোচনের মুক্ত গান গায়, আরেকটি বদ্ধ পতন যন্ত্রণায় কাঁদে, একটি উদ্ধত স্পর্ধা, আরেকটি বিনীত দয়া

ক্ষমতা ক্ষমতাকে সর্বদা উপভোগ করে, আর অক্ষমতা অক্ষমতাকে নিয়ে চিরবিব্রত

আমরা না-সক্ষম না-অক্ষম যারা মধ্যিখানে থাকি, তাদের মতো এত নিম্নমানের তৃতীয় শ্রেণি আর হয় না, ক্ষমতার লেজে পা দিয়ে আমরা অক্ষমতার গহ্বরে কেবলই হুমড়ি খেয়ে পড়ি

২.
আমরা যারা পারা দেয়া একমুখী কাচের ভেতরে থেকে ঘুরেফিরে নিজেকেই দেখি, রহস্য তাদের গিলে ফেলে, পৃথিবীর-- কূপের মণ্ডূক হয়ে ব্রহ্মাণ্ডকে ছোট ভেবে নিজেকেই এত করে ছোট করি যে ঘাসের রঙ কেন সাদাও হয় সেটুকু জেনেবুঝেও নিজের পাণ্ডুতা তেমন ঠাহরে পাই না

গতকালের আমির সাথে আজকের আমির মিল খুঁজে পেয়েও শুধু সময় এগোলো বলে কিছুদূর এগিয়েছি ভাবি, একটি পাখি কেন ডানা মেলে নেই পারা দেয়া কাচে, নিজের মুখের স্থলে, ধাঁধানো বিভ্রমে পড়ে, সে কথা কস্মিনে একটুও ভাবি না

আয়নাবিভ্রমে নিজের কাছে নাজেহাল হতে হতে আমরা ভাবছি-- জগৎটা এ জীবনে সম্মান দিল না

সমুদ্রে

এই মাটি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে সমুদ্র দিয়েছে-- টোলঘর, ঝাউবীথি ও কোকের পাহাড়ে বিলি কেটে আজ তার সমূহে নেমেছি, ভেজা ও চলনক্ষম বালিতে বালিতে, দূর সব দিগন্ত-আমোদী রচনায়, নিখিল সংগীতে

সমুদ্রজলের গর্জন আসলে এক নীরবতা, মনে এসে মিশে গূঢ় মন, দূরের জাহাজ, দেহে খসে আরদেহ রতি, উড়ন্ত চিলের পালক

ফেনাময় সমুদ্রপাড়ায় কোনো বিয়ারের ক্যান খোলা হলে, প্রথম সাপোর্ট আসে সমুদ্র থেকেই, জলের বর্তিত গতি মনে হয় বয়ে চলে লোকহিতব্রতে

২.
বিদেশ-বিভুঁ’য়ে এই লাভ হলো-- গর্জনশীলা এক সমুদ্র পেয়েছি বুকে, তার ওপরে হাওয়া, অফুরান শীৎকার

আদি পৃথিবীর স্যুভেনির বয়ে আনে এই বিশালতা, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সেসব জমা করে রেখে দেই বিশাল তোমার নামে, বিশালের নামে নিবেদিত এইসব ভালো, এই মন্দ, সূর্য সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে বহুকাল নৃত্য করে যাবে

৩.
বিশালতা কাকে বলে বুঝেছি সমুদ্রে নেমে, পৃথিবীর তিনভাগ জল মানে কত বারি বুঝেছি সেটাও, তবুও সাহস করি অনুভবে অতল ছোঁবার

দূরত্ব আসলে খুব কম তোমার সাথে আমার, মাঝখানে বয়ে গেছে ছোট নাফ নদী, অভিমান মোটে এই একটিই

বিশালতা বুঝি বলে বড়োর ছোটত্ব বুঝি, ফাঁকি বুঝি, ভেতরে যে মন থাকে, সেও-তো তিনভাগের চেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে আমার, কখনো তুমি তা জেনেছিলে

আমি তো পাখির বড়োত্ব মেপেছি চিরকাল, আকাশের বাটখারা দিয়ে

বসন্তভ্রমণ

বসন্তকালীন অপরাহ্ণে নদীর এপার-ওপার হচ্ছে ফাল্গুন মাস, পাশেই দু’টি বালকের মধ্যে ঢিল খেলা হচ্ছে বিস্তর, একজন নিচ থেকে ওপরে, ওপর থেকে নিচে আরেকজন, আমি দেখলাম নিচ থেকে ঢিল দেয়া বড়ো কঠিন কাজ, যে সূত্র সব সেক্টরেই কমবেশি প্রযোজ্য হতে পারে

এদিক দিয়ে নিশ্চয়ই পথ গড়ে উঠেছে বিকল্প কোনো, পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে যে মহিলা চুটিয়ে করছে স্নান, ওকে জিজ্ঞেস করে দেখব কি পথ কোনদিকে, কেননা আটকে গেছি, বিশ্বজনের ব্যবহৃত জল আসছে ধেয়ে বর্জ্যপ্রণালিযোগে, বিশ্বজনের পানের কৌটো, বার্থকন্ট্রোল পিল, বিশ্বজনের পরিত্যক্ত গামছা ও স্যানিটারি ন্যাপকিন, পুঁটিমাছ খলবল করে এখানেই বেশি, বড়শিঅলারাও তাই ড্রেনের কাছে থাকে বেশি বেশি, চারপাশে লাল লাল বসন্ত ছড়িয়ে আছে মাত্রাহীনভাবে, এর মাঝে পুঁটিমাছের সূর্যের সাথে খেলা করা দেখি আমি, আমারও বসন্ত বলে

আমি জলকে ছুঁয়ে দিতে পারি জল আমাকে পারে না, এই বাক্য সমুদ্র অভিধানে নেই, আছে শুধু নদী অভিধানে, পৃথিবীতে নদী আছে বুড়ো-হাবড়া যত, সার সার স্কেলিটন নিয়ে তার পাড় জুড়ে জড়ো করা আছে ঢের পরিহাস, ওটা কী গাছ তবু মড়া গরুর হাড়ের পাশে জন্মেছে নদীতে, পুঁটিমাছ জানা থাকলে বল, রোদে বসা ছিল আর মাত্র চলে গেল ওটা কি শঙ্খচূড় নাকি হেলুসিনেশন এই নারকেল বনে

মরানদে বুদ্বুদ বেশি ওঠে কাইক্বা মাছের এই কথা ভালো করে জানা, যেহেতু সে নদীবাসী, বালিহাঁসের যদি না-হবে ওটা তবে কীসের পালক, অত সাদা, আরেকটা ঝলক সাথে ওটা তবে কীসের পালক বলো উড়ে এসে পড়ল মাটিতে, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এই তবে বিকল্প পথ, খুরের দাগ দেখে ভ্রম হয় শেয়াল উদ্বোধিত, গাছালির ফাঁকে

একটি বালকের সাথে দু’টি বালিকা থাকা চলবে না, এ ঘোষণা নিয়ে যারা রাজপথ কাঁপাতে চেয়েছিল একদিন, কী জবাব দেবে তারা আজ নদীতীরে এসে, যেথা তিনটি মাত্র মেয়ে ঘিরে ছেলে হলো দু’দলে তিরিশ, টিজ করছে ওরা দলেবলে পালটাপালটি করে, এই ত্যাঁদড়গুলোর জন্যেই ঘটে নদীপারে অকারেন্স বহু, নিতিদিন, তবু এই টিজিংয়ের যতি টানা হবে না আমার, একা কেউ টিনএজ ঢেউয়ের সাথে পারে না পাল্লা দিতে, অস্তোন্মুখ সূর্যের প্রাণ কেড়ে নেয়া লালিমায়, গামছা ধোয়া জলেরও সাধ্যি নেই একথার অন্যথা বলে

অপমান জেনেও যারা সহজে হজম করে ছাইপাশ, তাদের দলবল বরাবর ভারী হয়, এদের থেকে দূরে লাল লাল ভরা ফাল্গুনে একা হয়ে থেকে যাওয়া ঢের ভালো, ফিরে আসি তাই, কিছু দেবার যদিও বাকি রয়ে যায় কিছুটা নেবারও, ফিরে আসি, কেননা ওইসব মুখরতা অর্থহীন বড়ো, মনেপ্রাণে মিশে যেতে পারি না যেসবে

যেখানে মুখরতা সেখানেই প্রাণ জানি, তবু, যেখানে নীরবতা সৃজন তো সেখানেই শুধু, আর নীরবতা মানে তো কেবল শব্দহীনতা নয়, মেডিট্যাড করা গেলে ভিড়ের মাঝেও নীরবতার সাথে ঘটে যেতে পারে এক জ্যান্ত মোলাকাত, নাতিশীতোষ্ণ, আমি জানি

মূলে ফিরে মুকুরের খোঁজে

ভবিতব্য ভেবে ভেবে এই যেভাবে দিনকে চড়িয়ে দিচ্ছি রাতের ওপরে আর রাতকে চাঁদের-- তোমাকে আমূল সে রন্ধনপ্রণালি জানাতে হলে আমাকে ঠিক উলটোটা খেলে যেতে হবে, কেননা তুমিও নও কোনো আগামীর দূত, ভবিরূপবাহী

খেলা খেলা এই জীবনের ভারে শরীরের ডালসব খেতজাঙালের নরম মাটির দিকে হেলে থেকে কষে যাচ্ছে পাটীগণিতের সব বই-- জীবন কতটা ভুলে সমাহৃত, কতটা ঘৃণার বিপরীতে একেকটা চলনসই ভালোবাসার বদ্বীপ জেগে ওঠে, এ হিসেব কোনোদিন মিলেও মেলে না

সবুজের কাছে শুয়ে থেকে একটা পুরো জীবন পার করে দেয়া গেলে বোঝা যেত, প্রকৃতি থেকে পাওয়া প্রাণশক্তিটুকু মানুষের দেহে-মনে কীরকম কাজে লাগে, একজন গ্রন্থকীট ভেষজবিজ্ঞানী জানি তার টিকিটাও স্পর্শ করে যেতে পারে না একজীবনে

এহ্ বাহ্য

বিমূর্ততা বিষয়ক

বিমূর্ততার বীজ নিহিত থাকে মূর্ত করতে না-পারার মধ্যে, এই না-পারা সূচিত করা উপসর্গগুলো প্রধানত অক্ষমতা অনাগ্রহ ও সীমাবদ্ধতার চূড়ায় চূড়ায় আভিজাত্যের রূপমহিমা নিয়ে সমাহিত থাকে

বিমূর্ততা হলো ঝলকের মালা আলো নয়, কোরাসের চূড়া সুর নয়, দেখতে এটি হতে পারে কিছুই না-এর মতো, অথবা ঠিক অনেক কিছুর মতো

বিমূর্ততা নিজাধীন চিন্তাসরণি, ভাবনাগোড়ামিহীন, যেদিকে ভাবনা যায় চলে যাওয়া চলে, আদর্শ বিমূর্ত হলো গোলআলুর মতো, বিমূর্ত আদর্শ হলো শৌখিন দূরবাস

বিমূর্ততা অতএব নন্দনের প্রগতি, প্রগতির নন্দন হলো অকাট্য মূর্ততা

স্বপ্নপুরাণ

পৃথিবীতে যতজন মানুষ আকাশতল্লাটে ততটাই তারা, একটা তারা জন্মায় একজন মানুষ জন্মের সাথে সাথে, একটা তারা ঝরে একজন মানুষ মৃত্যুর সাথে সাথে

প্রতিটা তারাতে থাকে এক স্বপ্নদেবতা, তারকার গায়ে যত আলো দেখি, সব ওই দেবতারই দ্যুতি, সন্ধ্যার নিকটবর্তী হতে হতে পৃথিবী যখন ক্রমে ডুবে অন্ধকারে, একে একে স্বপ্নদেবতারা নিচে লোকালয়ের খুব কাছে এসে জড়ো হয়, এসময় তারা জোনাকির রূপ ধরে ঝোপে-জঙ্গলে থাকতে ভালোবাসে, যে কেউ যখনই ঘুমিয়ে যায়, অ্যাসাইন্ড যে স্বপ্নদেবতা তার, চুপিসারে প্রবেশ করে ঠিক মস্তিষ্ক গভীরে, তারপর বহনকৃত স্বপ্নসিডি বাজায় নিচুস্বরে এবং সিডি ফুরিয়ে গেলে যথারীতি আকাশে ফিরে গিয়ে আলোক ছড়ায়

কার দেবতা বাজাবে কেমন সিডি, তার ওপরে হাত আছে মানুষেরই কাঙ্ক্ষার, যা অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধিতে নেই, এমনকি যাকে নিয়ে ছড়ায় নি চিন্তাও ডালপাতা, দেবতা বাজায় না কখনো তেমন সিডি, মানুষের এঁকে দেয়া সীমানায়ই ঘুরেফিরে দেবতারা, দেবতাও এখানে এসে মানুষের অধীন, জয় হোক মানবজাতির

শেষরাত পর্যন্ত কিছু তারাকে আকাশেই থেকে যেতে দেখা যায়, আসলে ওইসব স্বপ্নদেবতার যারা টার্গেট পিপল, তারা তখনো জেগে থাকে সে দেশে দিন বলে, একজনের দেবতা অন্যে প্রবেশ করে না কখনো, পৃথিবীর সকল মানুষ যদি ঘুমাত একসাথে, আকাশে তখন কোনো তারা থাকত না, পৃথিবী গোল বলে রাত-দিন সবদেশে আসে না একসাথে, একদেশে রাত এলে আরদেশে দিন, সব রাতে কিছু তারা আকাশেই থেকে যায় তাই

মেরু অভিযান

তিমি মাছের কণ্ঠা চুইয়ে জাগা বুদ্বুদসংগীত ছুঁয়ে-ছেনে দেখে নিতে যেজন পরিব্রাজক হলো বরফের দেশে, ঠিক দক্ষিণমেরুতে, আসন্ন অরণ্যা শীত, ভ্রমণসূত্র তাকে পড়িয়ে দিও মনে, সঙ্গে থাকা চাই তার দশাসই গরম কাপড়, দামী মদ, অতি সংবেদী কান আর যৎপরোনাস্তি লিখন সামগ্রী, একখানি দিক-নির্ণায়ক ও দূরবীক্ষণ যন্ত্র সঙ্গে থাকতেও পারে

গত শীতে যারা পেঙ্গুইনের সঙ্গমদৃশ্য দেখবে আশায় গিয়েছিল দক্ষিণমেরুতে, তাদের উদ্বৃত্ত খাবার সে সহজেই পেয়ে যাবে, আশ্রয়ার্থে যে এস্কিমো পরিবারের করবে সে আতিথ্যগ্রহণ, বাসি সিলে নিশ্চিত করবে ওরা যথাআপ্যায়ন

এটাই নিয়ম বলে ইগলুতে কাছে পাবে গৃহকর্ত্রীকে, প্রথম উচ্ছ্বাসে দিয়ে যথাসাড়া জানি স্লেজগাড়িতে শিকার করে দেবে সে সিল-সিন্ধুঘোটক, এরও আছে বিনিময় কিছু সিগনিফিকেন্ট, মেরুদেশে কেননা কোনো দেনই নেই লেনহীন, শরীর সাধক হলে বিনিময় হতে পারে আইসভার্জিনে

শরীর ব্যাপারে বাধকতা মানতে পারে না যারা, রতিপাপী হীন সেই ভবঘুরেদের লাগি রাহুলজি নিশ্চয়ই কোনো ক্ষমা রোচবেন, আমি মনে করি

কথাচক্র

গোধূলিবেলার মতো দ্রুত আমাদের কথারা ফুরায়, মুখোমুখি হতে হতে জমেওঠা যতসব আলোতাপ সহজ শিথিল হয়ে মি’য়ে যায় খুব, বালির পাহাড়ে চড়া বৃষ্টি পরশমালার সচিহ্ন স্বীকারোক্তিটুকু যেন শুধু থাকে

হয়ত মনোলোকেই তারা মরে যায় ঢের কিংবা কণ্ঠার জোর সুগমতা ছেড়ে আনরঙে প্রকাশ মরিয়া হয়ে কিছুদূর হাঁটে আনঠায়-- অন্বেষা বহুল হয়ে ভেঙে ভেঙে পড়ায়, সুকুমারী কাগজের বুকে

নীরব দিগন্তে চেয়ে কথাদের না-কথা হওয়া দেখি তারপর, মড়া সামলাই যত আকথা ও কুকথার, দূর ঝরাপাতাদের গাঁয়ে দলে দলে অবলা-বলনকেতা লীন হতে দেখি

কথারা ফুরালে আমরা আবার হারাব নিজ অন্ধকারে-কারে-- ফিরে আসাগুলো তবু থেকে যাবে আপাতসুন্দর, আকাক্ষাজড়োয়া বল-- আমাদের কথামালা নেতি নেতি চক্রে ঘুরে সদা সমুজ্জ্বল

নিবর্তন সংবাদ

গাছলতাপাতাদেরও সভাকবি থাকা লাগে নাকি, পাতাদের ঝরে যাওয়া লিখে রাখবার কেউ কি নেই ওই বনদেশে-- জেগে ওঠবার অব্যবহিত পরেই চর পড়ে যাওয়ার যে ব্যথা, অসহনীয়, লালন করে করে খাক হয়ে গেছে ভরা নদী, কবি ওই সংবাদ লিখে রাখে নিজ ফরমাশে, মাছের সাথে নদীর যে নিত্যপ্রণয়, গাছলতাপাতারা সেখানেও স্বমহিমা খুঁজে, অণু-পরমাণু সব ধরে এনে একখানে জড়ো করে রাখে, সোৎসাহে বলে যে এভাবে লেখ-- নদী এই লতাদের হাতেপায়ে ধরে তবে এমএ পাস, দ্বিতীয় গ্রেডে, তিনপুরুষ ওর খোলাহাওয়া বেচাবিক্রি করে খেত খালি নুনভাত, তাও ওদেরই পুবের পালানে বসে, কয়লার রহস্য যদি জিজ্ঞেস করা যায় নদী বরাবরে, কিংবা বলা হলে মার্স গ্যাস কোথা থেকে আসে, ঠিক ঠিক ওরা বলে বসে যে সবই এই লতাপাতা থেকে-- অবলা হে গাছলতাপাতা, কীভাবে সম্ভব বলো এত জানাশোনা, পাঠক্রমে এত কিছু ঢুকলো কীভাবে, তোমাদের কি সর্বজনগ্রাহ্য কোনো শিক্ষানীতি আছে, আমাদের নেই, লেজেগোবরে এক পাঠক্রম ফলো করে এটুকু জানাও আমাদের বাকি রয়ে গেছে যে, নদীর কনিষ্ঠা চাচাত বোন এতখানি বাড়া আজ তোমাদেরই বাগানের শাকসবজি খেয়ে

গাছলতাপাতাদের প্রজাপতি সংস্রব উপভোগ্য বেশ, ওই হৃদ্যতাকথা যেদিনই লিখতে বসে কবি, কলম ধরে সে যে কেমন এক হেঁচড়াটানা, পারে তো লিখে দেয় লতায় প্যাঁচিয়ে ধ’রে হাত, লিখে, ভালোবাসাজাত যাবতীয় অতিকেই আমরা শেষাবধি মেনে নেই, খুশিমনে, যেজন্যে ভালোবাসার জন্যে ফিরি দ্বারে দ্বারে ভিখিরির প্রায়, কিন্তু ভালোবাসা ব্যাপারটাকে সংজ্ঞা-কাঠামোতে নিয়ে যেতে ওরা ঠিক কী কী শব্দ ব্যবহার করে, এতদবিষয়ে সদা প্রতিবেশী সব ফড়িংকেও অতিকায় এক অস্পষ্টতার নিচে লুকিয়ে রাখে, লিখে, আমরা পুরানো দিনের গানের খুব ভক্ত গো, রোদ ঝলমল যত সকালবেলা ওদের, ফিরে নাকি আসে নি কখনো আর কোনো শীতকালে

পতঙ্গভুক লতার হাত ছাড়িয়ে কবি লিখে, যাকে হারায় তাকে পাবার জন্যে যে ব্যাকুলতা, মানুষেরা তা থেকেই ধারণা করে বসে যে সমস্ত অতীতই চিরকাল সারবান-- প্রত্যক্ষ, অনুমান, আপ্তবাক্য-- এই ত্রিবিধ প্রমাণই সেখানে ব্যর্থ যদিও, এটি মূলত পরিচয়ের প্রতি মানুষের এক সহজাত টান, অপরিচয়ের প্রতি সন্দেহ, সমাজ-রাষ্ট্রের বদ সব অস্থিরতাও এসবের বড়ো গূঢ় প্রণোদনা বটে

বাজাই বাজাই করে না-বাজানো বাদ্যগুলোর অমিত সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে ভার কাঁধে দূরপথে হেঁটে যাবার বেলা চোখেলাগা পাহাড়ি ধ্বংসলীলা কীসের মহড়া ওগো লীলাবালি, পাথুরে ধরন আর অল্পসল্প তেঁতো, সে কি আপাত অপরিচয়ের নিচে এক অতিকায় প্রাণজাগ দেয়া নয়, গাছলতাপাতাদের ঢের কাছে

হেমন্ত ও না-হেমন্ত

সৌরচ্যানেলে এমনকি পরিচিত পৃথিবী নামক গ্রহের ঘূর্ণনছাপও স্থানভেদে লোকালয়ে ভিন্ন ভিন্নভাবে পড়ে, বোদা ও শিবগঞ্জে বর্ষার আগমন ঘটে তাই খানিকটা আগেপিছে, পিছিয়ে পড়া হেমন্ত ঋতুকে আজ যে দেখেছি ছড়ানো মাঠে, কুয়াশায় মাখামাখি করা সোনালি-সবুজে, সহসা কামাখ্যা-কামরূপে, একমাত্র অনুঘটক নয় এর ওই সৌরঘটনাটি

হেমন্ত ও না-হেমন্তে এই বিরোধের ভাষা, এই কালভেদ, জানা নেই, দেখেছেন কীভাবে লাবণ্যপুরের দাশবাবু আর অন্যেরা হেমন্তপাগল, শীতগন্ধী এই ঋতুর পোশাক পরে আমরা যারা আদিগন্ত প্রান্তরশয্যায় মৃত্যুকে গুটিসুটি শুয়ে থাকতে দেখি, তাদের চোখের কাচে আজ কি খানিকখানি ময়লা জমেছে

আমি ভাবি-- এইসব, এই ঋতুর মার্বেলগুলো যেপথে গড়িয়ে চলে, সেইপথ কিছুটা গীতমসৃণ হলে ভালো, কিছুটা সুরমসৃণ, যদিও জোয়ার-ভাটা প্রায়শই ঢেউসংকুলতা সঙ্গে নিয়ে আসে

আজকাল, বার্ষিক গতির ওই কথিত ষড়ধাপ আগাপাছতলা কমই আলাদাত্ব ধরে, আসলে পরস্পরের ভেতরে তারা ঢুকে থাকে যেন গ্লাসের ভেতরে রাখা গ্লাস, আমার তো এরকমই ধারণা অন্তত-- আপনার

ভিখিরির রাজ্যপাট

সাহস করে শুরু করা লাগে, শুরুটাই আসল, এ বোধটিই মহার্ঘ্য সবচেয়ে, ওই তরীতে চড়েই যাওয়া যায় ভাষার ওপারের কোনো বচনহীনতায়, অনুভূতি দিয়ে যেথা স্বপ্নবুনন, ও সুরটি গাওয়া-থোওয়া হলো না বিশেষ, হাতকণ্ঠ জাপটে ধরে আছে মনোকঠোর এক বাধা, এরপরও সুযোগ থাকে, থাকে সামাজিকতাও, ভেতরে ভেতরে এটি খুব বিমর্ষতাবোধ, বাইরে না-বোঝা গেলেও, পরে শেখা কিন্তু কাজ করে আগে, একে তুলাধুনা না-করে দেয়া গেলে, মঞ্জিল থেকে ম্যালা দূরে তাঁবু খেটে’ থেকে যেতে হয়

ভাষা নাকি কল্পনা ওর মন কেড়ে গেছে সেটা বিবেচ্য হতো না, যদি জগতে পছন্দভেদকে একটা মাত্রা হিসেবে তুলনা করবার সুযোগ না-থেকে যেত, এর সাথে চলার ও বলারও থাকে যোগ আর সাজশ, বহুদিন একসাথে থেকে গেছে যারা, একাকী দেখে নি যাদের কেউ, তাদের যৌথতাকে বুঝতে হলেও এককাস্তিত্বের প্রতি তাকাতে হয়, নইলে কেমন খাপছাড়া ও ভুলে ভরা লাগে সব, দু’য়ের আলাদা মহিমার অনেকাংশই তা না-হলে চিরকাল চাপা পড়ে থাকে, শেষপর্যন্ত একাকিত্বই প্রিয় মুহূর্ত সবার, যদি একা হওয়া সত্যিই থেকে থাকে, শরীরে ও মনে

আমাদের অনেকেরই মোটে একা হওয়া নেই, অত সহজ নয় বলে কেউ কেউ ভুল বোঝে একা হওয়া মানে, কারখানার ভেঁপুর চেয়ে বাতাসের হ্রেষাধ্বনি একা হওয়া আগে শুনতে পায়, ওদিকেই অবস্থিত ধ্যান-রাজ্যপাট, স্থান এজন্য জরুরি বিষয় খুব, এ ভেদে রকমফের আছে মাত্রার, ধ্যানঘরগুলোর অবস্থান দেখে বোঝা যায়, ধ্যানীরা বন আর পাহাড়ে বেশি আগ্রহী, গাছ আর পাথর কি তবে ধ্যানী সবচেয়ে, দেখে শেখার এই কি তবে শেষ আশ্রয়, বনে বা পাহাড়ে যাদের অ্যাকসেস নেই, তাদের কী হবে ভাবতেই দেখি যে এরও কিছু বিকল্প আছে মানবভূগোলে, বানপ্রস্থে বা সন্ন্যাসে না-গিয়েও, সংসারে থেকে, সুরে ও নিশীথে, তবু মানতেই হবে একা হওয়া এ সমাজে বিরল ঘটনা এক

বন্ধ্যানদীর তীরে দাঁড়িয়ে যতটা দূর ভাবা যায়, তার শেষপ্রান্তে আছে সব ধরনের সক্ষমতার দিকে স্বপ্নকে মুচড়িয়ে নিয়ে ডাঙায় তোলা, এরকম রাখালি আমি বহুদিন করে যেতে চাই, পাজন হাতে, তারই নিমিত্তে আজো ভেড়ার পালের সাথে মাঠে মাঠে ফিরে করি ঘাসের কারবারি, অলস দিনে যাবতীয় স্যাঁতসেঁতে স্থানে যেসব নিরুৎসাহ মাশরুমের মতো গজিয়ে উঠেছে, তার সব বোকা ও অননুসন্ধিৎসু, এটা ভেবে মনটা তখন খানিক স্বস্তি পায়, মাটিতে থুবড়ে যাওয়া সবকটা ভাঙা নৌকাকেও তখন বেশ নান্দনিক বলে মনে হয়

গানের দিকে

আরো নিচে থেকে শুরু হওয়া চাই, ঠিক মূলানন্দ থেকে, তারপর একে একে ওপরে আকাশে যত পারা যায়, উড্ডীন বাতাসে মেলো পাখা, ভাসো ততটা দুরন্ত লয়ে মৃগীর মনের মাঝে যত লাফ লেখা থাকে সৃজনী আঁকের মতো উদ্ভাবনীময়

চাও তো এখানে এই ঠোঁটের আগায় রেখে একটি গানের কথা, শাসনসাধন ফেলে অভিকরণীয় এক রোদের হাসির মতো দূর চক্রবালে পারো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে, ঠোঁটে মোহন আবেগ যত, কণ্ঠে তার সবটা মাখিয়ে নিও, প্রতিটা ধ্বনি থেকে নিষ্কাশিত হবে যেই ইতিহাসবোধ, গলায় খেলিও ঠিক সেইমতো আনন্দ-বেদনা

ভেসো ওজনবিহীন হয়ে, থেমো পুরঝরনার মতো

২.
একটি গানের দিকে হেঁটে যাওয়া মানে হলো প্রকট বাঁধন থেকে মুক্তিএষণা, প্রবীণ পাথর-পাহাড়ে আর প্রসাধিত বস্তুপুঞ্জ ঘিরে তুড়িতে জাগিয়ে দেয়া বৈরাগ্য বাসনা, ঢের ঢের বাউল ভাবনা

শীত আসছে

শীত আসছে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে পালক জাহাজে চড়ে কুয়াশার নদে-- নীলপাখা লালশীর...

শীত আসছে ঝরার আনন্দ বোঁটায় কাঁপা কাঁপা পরিহাস মাখা-- সরালি লেনজা...

শীত আসছে কুয়াশা সকালে ঘাসপথে পায়ে হেঁটে-- পান্তামুখি পাতিহাঁস...

পাতাকুড়ানি মেয়েরা জানে পাতার মহিমা, ঝাঁপিতে ওদের মচমচ করে শীতেদের অন্দর-বাহির, শরৎ ও হেমন্ত-সঞ্জাত পরকীয়া, যাবতীয় গোপন খবর

কাল বৃষ্টি ছিল আধাদিন কাল পাতাকুড়ানো বন্ধ কাল লেপকাঁথা আজ পূর্ণদিন আজ পশমের শাল

অশ্বত্থের গোড়া জুড়ে গাছেদের বনসভা আজ, যাতে সবুজবক্তারা পাতা ঝরানো বন্ধ করে দেবার কথা বলে দাবি তুলবে যে সকল গাছেরই অন্তত কুড়ানিসমিতির সভ্যদের থেকে কিছু সমীহ পাওয়া উচিত

হ্রদে অতিখি পাখির সন্তরণ, শিকারি আতঙ্ক, কয়েকটা বর্জিত পালক মেকি উম ফেলে রেখে, ওরা যদি হয়ে যায় অনন্ত বিমুখ, আরেককটা জলসভা হবে শিকারবিরোধী

শীত আসছে বনে প্রোজ্জ্বল আগুন পোহায়ে পোহায়ে-- পিঠাগন্ধী শীত

বর্ষানিদ্রা

একটা বিষণ্ন ভেজা কাক তেতলার কার্নিশে বসে চালুনি-আকাশের প্রতি করছে লাগাতার বিষোদগার, আয়নায় দেখা আমার এখনকার কুঞ্চিত মুখাবয়বের সাথে নিবিড় এক সাদৃশ্য দেখে ওর, এ উপাত্তটি আমি আন্দাজ করেছি যে ওতে ও আমাতে অমিলের চেয়ে মিলই এখন বেশি-- এ বেলায় ভুখা আছি দু’জনেই, নিঃসঙ্গতা দু’জনেরই সঙ্গী এখন, যেটুকু অমিল শুধু অবস্থানসূচক, আমি আছি গৃহবন্দি কাকটা বন্দি কার্নিশে, চুল আর বালের পার্থক্যের মতো যা মাইনর খুব

সকল বঞ্চিতই পৃথিবীতে একজাত, সাজাত্যপ্রেমে তাই ডাক দিয়ে বলি, ওহে ভাই জাতভাই, এ বেলায় ডুবি আসো বর্ষানিদ্রায়

শব্দজীবনী

হেজে ও মজে গিয়ে যেসব শব্দ এখন অভিধানের ভারী তলপেটে অনিষিক্ত বীর্যের মতো শ্রান্তিতে আছে, নিবিষ্ট খেয়াল থেকে সাদরে তাদের তুলে আনো, তারপর পরিশোধন করে কর নবার্থ দান

শব্দের অতীত ছিল প্রাচুর্যময়, সরব, আমাদের পরকীয় দিনে, বিপুলা ধানের গোলা ফাঁকা করে মিশিয়ে গেছে তারা দেদার চিটা, দখিনা বাতাস এলে উড়িয়ে সেসব ধান, পুরানো মহিমাখানি খুঁজে নিতে হবে

জলজাত জিনজাত এই তুমি হারানো শব্দ ধরার খেলো খেলা, যাপিত জীবন তার ছত্রে ছত্রে এঁকে রাখ ফলিত কাগজে, কেননা তোমার ভাষা রাতেদিনে রেপ হতে হতে রুগ্ণ ও ক্লান্ত আজ, স্বরূপে তাদের ছবি এঁকে যেতে হবে

শব্দকে তুমি জন্মও দাও, দিতে পার তুমি শব্দবান, ধ্বনির সাথে দাও ধ্বনির বিয়ে, জাগিয়ে তোলো নতুন এক বাঞ্ছিত অর্থসরণি, এই হলে তুমি আর তোমার চতুষ্পার্শ্বে বিরাজিত সবিশেষ শব্দজীবনী

মানুষ মূলত একটা শব্দের অধিক আশ্চর্য কিছু নয়, একটা মাত্র শব্দই পারে তার সমুদয় কর্মকথা প্রকাশ করিতে

বিস্ময়, দূরে বাস করে

‘দূর’-- শুধু হাতে নাগাল না-পাওয়া এই শব্দপ্রীতি জাগতে জাগতে সে এসে হাজির হলো সশরীরে, যাকে বহুকাল কোথাও যায় নি পাওয়া দেখায়-শোনায়, কম্পমান সদাশয় দারুণ বিস্ময়, তাকে ছাড়া কবিতার দিকে হেঁটে ক’দিনেই অবসাদ পিঁড়ি পেতে বসেছিল প্রশস্ত ইচ্ছায়, সরব আঙুলে

দীর্ঘ এ অদেখার সূচনাবিন্দুতে ছিল ধীর স্বপ্নঘোর, জেগে দেখি সবদিক চুপসানো স্বাভাবিক, কোনোদিকে বেড়েওঠা, নুয়েপড়া, লাফানো বা জড়ানোতে মিশে নেই ছোটখাটো বিস্ময় রেণুকণা মেলে, পেঁজা পেঁজা তুলোও দেখি নি কোনো দলবেঁধে উড়ে যেতে

শব্দটি কাছে এসে ত্রাণকর্তারূপে আমাকে জাগিয়ে তোলে ক্লান্তির থেকে, কেননা তা বিস্ময়াবিষ্ট ছিল, কেননা ও-জানালায় রাতেদিনে যত নেত্রপাত, বিস্ময়ের ভেতরে থাকা বিস্ময় অন্য আরো লাখো বিস্ময়ের পেছনে পেছনে অবিরাম তাড়া করা প্রতিভাত করে-- দূর গিয়ে গভীর সুদূরে মিশে রচনা করছে যেথা সুবাহারি মোহ, অধরা-অছোঁয়া

সাদার ওই আতিশয্যটুকু

রাষ্ট্রব্যাপে তুমুল অরাজকতা আজ, আর প্রেমিকের নামে শুধু উপেক্ষা রোচে এই পোড়া দেশে-- এসব দেখেশুনে একটি বয়সে এসে থেমে গেছে পুষ্পসম্ভবা সমুদয় কাশের বিকাশ, যেন কিছুই আর যাচ্ছে না ছুঁয়ে রোদজলহাওয়া, অথচ শরৎ এসে বসে আছে চরের কিনারে একা, সদাউল্লাসীদের অত্যুৎসাহেও মুখভার করা তার, দলছুট দুয়েকটা বেয়াড়া কাশ যদিও বিচ্ছিন্ন সাদা ছড়িয়ে প্রমাণ রেখেছে যে সকল কমিউনিটিতেই কিছু সীমা অতিক্রমকারী-ও-কারিণী থাকে

অবশ্য সেভাবে চাইলে কেউ, এক তুড়িতেই ফুটিফুটিদের পুরো ফুটিয়ে দেবার আছে নিসর্গবাদক, চর জুড়ে ডাকাবার আছে শ্বেতশুভ্র বান, দীর্ঘ সহবাস বলে কাশেদের গূঢ় সুপ্ত মনোভাবটুকু যার জানা, যেকোনো হুকুম তামিলে তাই, ওরা ও অচিন বৃক্ষেরা সদা উৎকর্ণ থাকে, একদিন যেমন হতো শিল্পাচার্যের বেলা, হতো কি না খুব করে জানে সেটা ব্রহ্মের পুত্র প্রবীণ

তো কেউ একজন যদি এগিয়ে এসে জানান দেয় যে সে অপেক্ষা করে আছে পূর্ণ বিকাশের, সাদার ওই আতিশয্যটুকু তবে উপভোগ্য হতে পারে, এই অবেলায়ও

খামার প্রকল্পের অনুকল্পগুলো

এখানে ধ্যান করতে যারা আসত তারা বুদ্ধিমান, কেননা শালিক পাখির দল কোনো মন্দ বাক্য কখনো উচ্চারণ করেছে একথা কাঁঠাল চাষ প্রকল্পের একটা চারাগাছও বলতে পারবে না, পথিক দু’চারজন যারা আসেও বা এদিকে নিজেদের মধ্যে কথা বলে বলে তারা নারকেল বনের পথ ধরে, এখানে ধ্যান করতে যারা আসে তারা ভালোই করে

পাতাকুড়ানি যেসব কিশোরী পেয়ারা খেতে খেতে নিজেদের কথা সারে পরিত্যক্ত খামার ঘরে এবং যেসব স্কুলড্রেসপরারা সাদা স্কার্ফের থেকে বাইরে বেরিয়ে ঘাসপাতা নিয়ে আনন্দ করে, তাদের কারোরই এখানে ধর্ষিতা হবার আশঙ্কা নেই, একথা খাঁচা ও কাঁচি নিয়ে মাঠে বেরোয়াদেরও পর্যন্ত জানাশোনার মধ্যে পড়ে, যদিও মাঝেমধ্যে বেড়ারও খেত খাওয়া সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ও ধারণা এক জীবনে আমাদের অনেকের স্মৃতিতেই অমলিন হয়ে আছে

বস্তুত এখানে কোনো ধ্বন্যাধিক্য নেই, ধনিচা বনের মাঝে খেলারত পাখিদের কলরব ছাড়া, এখানে যারা প্রেম করতে আসবে তারা পরস্পরে লীন হয়ে রবে

২.
ঘুঁটেকুড়ানি বালিকার গা ঘেঁষে একটা পিক-আপ ভ্যান চলে যায় দ্রুত কোনো জরুরি প্রজেক্টে, সন্ত্রস্ত বালিকা গড়াগড়ি যায় মাঠে, দূর থেকে দেখি তাকে উদ্ধারে ছুটে আসে শুধু দু’য়েকটা শালিক পাখিই, ঘুঁটের সাথে যাদের আত্মীয়তা বহুজন জ্ঞাত

মাড়াইযন্ত্রের নিচে নাক ডেকে ঘুমায় খাকি পোশাক পরা খামাররক্ষক, রাখালদের মধ্যে লালজামা পরাটাকেই অল্প একটু চালাক-চতুর বলে মনে হলো, কখনো-সখনো যে হাতের পাজনের সাথেও কথা বলছে, কিন্তু তারও ওদিকে কোনো হুশ নেই, তাছাড়া গরুর লেজে ধরে টানছে যে মাঝবয়েসি, কালচে ল্যাদার নিচেই সে একদিন জীবন সঁপে দেবে

এটি একদমই অনুমান যে, ঘুঁটেকুড়ানির গরুর পিছেই হাঁটা সঙ্গত বলে পিক-আপের ধাক্কায় আহত বালিকার বিপক্ষে ‘বড়ো সড়কে উঠেছে সে শটিবন রেখে’ ধরনের অভিযোগ আনা হতে পারে, তবে বেপরোয়া পিক-আপটি থেকে যাবে অভিযোগমুক্তই, কেননা ওটির যিনি মালিক, খামার এলাকায় চরে বেড়ানো সব গরুদেরও তিনিই

কেশুতিপাতার মতো আমিও চাই না যে কোনো রক্তপাত পৃথিবীকে কলূষিত করুক, তাই শালিক পাখির দলে আমাকেও শেষে নাম লেখাতে হলো, গাছগাছালির দিকে খানিকটা ক্রলিং করে গিয়ে

৩.
বগলে ছাতা নিয়ে রৌদ্রে হাঁটতে হাঁটতে কালো গা ততধিক কালো করছে যেজন, পরনে তার শাদা ও সবুজ, সবার গায়ে যেহেতু সমান লাগে না রোদ আর ব্যবহারে ব্যবহারে হয় ছাতাদের আয়ুক্ষয়, এইমতো মিঠে রোদে চিরকাল ছাতারাম জয়ী হয়

কখনো ভাবিস না ক্যাচক্যাইচ্চা পাখি যে আমি খারাজুরা গাছতলে আসি জুতাখালি পায়ে, সহসা দৌড়ানো কোনো গরু নিয়ন্ত্রণে রাখালি কৌশলে জানিস পা চুলকানির বিরুদ্ধে করণীয় কাজও আমি মাঝেসাঝে করে থাকি, তুই তো জানিসই যে, যারা খামার ভালোবাসে, তোদের সব কাণ্ডকলাপ ভালো করে শিখে রাখে তারা

৪.
একা তালগাছ আমারও চেয়ে, আহা একা হওয়া, সাদাচুল সাদামেঘ শারদীয় দিনে, পাশে তার এতসব কাণ্ড ঘটে যায় ঈশ্বরের রাতেদিনে

‘যদি ওর শাবককে না-আঘাতি, ওর কী দায় আছে তবে আমাকে আঘাতে’-- গাভি বিষয়ক এই জটিলতা গাভি ও গাভির রক্ষকে গিয়ে থামে, শাবকেরা করে না কখনো ঠিক তবু কিন্তু করে, কিছুটা আগ থাকতে দায় নিয়ে ফিরে যায়

এবার গাভির পাশাপাশি তার বর্জ্যচিন্তাটা মনে জেগে ওঠে, কেননা গো-মলের ব্যবহার ঘরে ঘরে পবিত্র মেজাজে, মানুষ তার ব্যবহার্য তালিকা থেকে বলা চলে কিছুকেই প্রায় বাদ রাখে নি

মাঝেসাঝে আমারই মতো একা হয়ে দূরে যায় নগরীর দুপুরের চিল, দল ছেড়ে, পৃথিবীতে দেখা ও না-দেখা ম্যালা প্রাণী আছে, কখনো হয়ত সবাই একা হওয়া ভালোবাসে, ভালোবাসে গরুও যে দেখেছি স্বচোখে, মনে হয় গরুর অধিক দ্রুত মানুষও বোঝে না যে আমি খুব একলাপ্রিয়, একথা সে সহজেই বুঝে গিয়ে বড়োশ্বাসে বুঝান জানান দিয়ে পানিপথে দূর দিয়ে চলে গেছে, অবশ্য সকলে করে না এক এইটুকু মেনে নেয়া থেকে যায়, মনে ভবিদৃশ্য চমকে চমকে ওঠে, অথচ ভবিতব্য বুঝি না ঠিক কল্পনা ছাড়া

চিলেরা উড়ে গেলে গাভিও দূরে যায় তার শিং নিয়ে, রক্ষকও বিরক্ত করে না বড়ো, আমি তালগাছের মতো অত বুদ্ধু নই যে নিজের কাজ নিজে করব না, কিংবা দুগ্ধরূপিণী এই দেশে আর্তি করতে করতে হাসপাতালগামী অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আবারো মেশাব ঝাল চিন্তাব্যঞ্জনটাকে, তাই উঠে পড়ি পথ দেখি তেল এবং নুন সন্ধানে

বিজয়গুপ্তের বাড়ি

মনসামঙ্গলের কবির বাড়ি সাপের মতো প্যাঁচিয়ে আছে লতাঝাড়, ফুল তার জমকালো মাথার মণি, চারিদিকে মন্ত্রের নিষেধ ধ্বনি শুনি আমি পয়লাই রয়ানির গন্ধ নিতে গিয়ে, বীণে ভর গেয়ে ওঠে ভীতিরব, শনি

পদ্মানামা গালমন্দে আকাশ ভাসিয়া যায়, ধুয়ে যায় জলে জল গাঙুর ও ঘণ্টেশ্বরের, সসম্ভ্রমে নজর বুলালে ফের নিকেতনে-- প্রফুল্ল শ্রী নিয়ে এক জেগে ওঠে বিমনা ফুল্লশ্রী, যেন উদ্ভিদ এক পতঙ্গভুক, লতায় পাতায় আর আঁকশি-মায়ায় বেঁধে, কাবু করে ফেলে দেয় ছড়ার ভেতরে

জয় হে বিজয়গুপ্ত, জয় মণীন্দ্র-মৃদুল যত উত্তরগুপ্ত আছ হে, জয় ফুল্লশ্রী ও জয় গৈলাহাট বলে, মন্ত্রমুখে ছড়া থেকে উঠে শেষে ফণার প্রকোপ থেকে ফুটি-- যখন গৌরনদী, দধির ভাণ্ড ছুঁয়ে মনে হয়, এ বেলায় ছানার মতো আলুথালু মরে বেঁচে আছি

হাওয়া

শুকনো পাতায় পাতায় প্রণয় লিখে ছেড়ে দেই হাওয়ার উজান থেকে তোমার দিকে, হাওয়া যদি প্রণয় বোঝে থাকে আর যদি সৎ হয় আর যদি পরস্ত্রী লোভী না-হয়, ঠিক তোমাদের উঠোনে নিয়ে ফেলবে পাতাগুলো

আর তুমিও যেমন, পাতাগুলো কুড়িয়ে পাবেই, এমনকি সন্দেহ করি, লালপায়ে নীলখাম বেঁধে আরদিন কবুতর উড়ায়ে দেবে ফেরত ডাকে

ঘাসের গল্পকথা

খোদার তিস্য দিনই কেন তোমাকে ভাবতে হবে খণ্ড খণ্ড করে, কেন জাগিয়ে তুলবে নাড়াবে, কেন পারব না দীর্ঘসময়ব্যাপে অন্যকিছু করতে বা করাতে, আমি কি বিক্রিত হয়ে গেছি কাঁচাদামে, তবে হে কী মধুর আমি পেয়েছি সাক্ষাৎ যে সংসার নন্দনহোমে বসছে না উড়ু-গাঢ় মন, কেন পেছনে ভাটির দেশে কানু নাচালে সুরেরে

কী আছে মোহরবনে কুহুগানে, কতবার পাখালির ধ্বনিরসে সচকিতে ঝরেছে উড়েছে রেণু, কতবার তনুকুসুমের ঘ্রাণ দিয়ে গেছে সুখাবেশ যৌবন অকারণ গোধূলি মলিনে

আমি তো জেগেই ছিলাম, এখনো জেগে আছি, মনোজল ঝংকারে বাজে বিকেল পালানো বৃষ্টির ছোরাঘাত, চন্দ্রিমা হ্রদের দেশে পিচপথে বৃক্ষ থিতানো জলের সিনান ধ্বনি শুনি কানে কানে

বৈচিত্র্যহীন যত দিন যত রাত বিস্বাদ, তাদেরই পত্রপল্লবে এ কী দোলা, এ কী মর্মর, এ কি ঘাসের গল্পকথা শুনে শুনে বিকেলকে ঠেলে দেয়া বিগতকালের কোনো শ্বাসরোধী গল্পের যবনিকা পটে

সেই কল্লোল

সেই কল্লোল থেকে গেছে সমুদ্র সমীপে, রাখাইন মেয়ের চোখের নদীতে, পায়রায়-- তার স্পর্শবিনুনির মর্মে মর্মে আলো, বাণীময় তারকারজনী

টিমটিম লণ্ঠন-আলোয় মোড়া নৌকাজীবনগুলো গাঢ় লবণজলে স্নাত, সেই হেন জলকীটকুল ক্রমাগত যথাসিক্ত দূরবীনবার্তা সব তীরে তীরে পাঠিয়ে চলেছে এতকাল, বাঁকে যার সুনাশিনী কেতকিকাঁঠাল, ঘন প্রেমকাঁটাবন

গূঢ় এক দুঃখবিলাসে-- সেই কল্লোল থেকে গেছে মনের মুকুরে

ভদ্রলোক

নীলজামা পরা দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক একজন যার গা ভরতি পেট, দাঁড়ালেন এসে প্লাটফরমে হাঁপাতে হাঁপাতে, আর বমি করলেন অপাচ্য কিছু বিধ্বস্ত নারী ও পুরুষ, যাদের কুঁচকানো জামাকাপড়ে ময়লা ও দুর্গন্ধ এবং লটবহর লটবহর, গ্রাম থেকে আসা শীতের শবজির মতো সদ্যস্নানা লসলসে কিছু তরুণী, গায়ে চাপিয়েছে যারা আনকোরা জামা এবং সালাদ হিসেবে মেখেছে দামী প্রসাধন, আর কিছু পুরুষ সুদর্শন ও স্মার্ট এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তান মালপত্রসহ পড়িমরি স্রোতের মতন ঢুকে গেলে পেটের ভেতর, হিসু করলেন তিনি জনসমক্ষে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে, এবং একখানি ঢেকুর তুলে তীব্রশব্দে, হাঁটতে লাগলেন বুক দিয়ে গাছগাছড়ায় বিলি কেটে এঁকেবেঁকে লাউডুগি সাপের মতন

একটি শব্দঅধ্যাস

সারারাত দাওয়ায় বসে গুড়গুড়িতে তামাক টানে যে সে অনুচর কার, আত্মার-- সেই কখন থেকে আছি কান পেতে একা ঘুমের জানালা থেকে, অধোমুখে, এলিয়ে পড়া আমার এই সমূহ আগ্রহ আজ পূর্বজগণের সব নাম এবং ধামের দিকে ঝুঁকে আছে ঝুমকোজবার মতো, আমি যার কিছুই জানি না প্রায়

পিতামহ, জানি, তামাক ছেড়েছিলেন মৃত্যুরও ম্যালাদিন আগে, মনে কি করব এটি প্রপিতামহের কাজ তবে, ঘোড়ায় চড়ে যিনি আসাম যেতেন আর ফিরতেন লালবাহাদুর হয়ে, অথচ ঘোড়ায়ই, তিনিও ছিলেন কিনা তামাকসেবী কেউ, জানি না তা, বাবাকে জিজ্ঞেস করে এ খবর জানবার আমার আগ্রহ নেই মোটে, আমি কি তবে ডাক দিয়ে বলব যে মৃত্যুর ওপার থেকে আসা চর তুমি যেই হও, তামাকটা শব্দ না-করে খাও, আর বলে যাও, চেনো কি না যাদের আমি উত্তরাধিকার বহন করি জিনে জিনে, কোন সে অর্বাচীনে, গহনগ্রহণে, বছুরে মড়কের ভয়ে ছেড়ে এল ওপারের মাঠ, ফসলের মাটিলতা ঘোরে অশোক পালের মঠে, পশুবিক্রির হাটে হাটে ভেষজবন্যায়, বন্যা সেবার ওই অতবড়ো প্রবীণ গ্রামের দেহে, ভেসে এলে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে বটের ঝুরির সাথে, ব্রহ্মের পুত্রের ঘন কাঁচামিঠা স্রোতে, ঠেকেছ কি ললিত এ পাহাড়ের গায়ে, অবশেষে

আমারে জানাও তবে আজ এই অজানার ভুরু, স্নিগ্ধ মনস্কাম, চোখে-কানে-নাকে-ত্বকে-জিহ্বায় লুকানো যত লাবণ্যপ্রতিভা, জেনের সরস রসে ভিজে যাওয়া মনে, উড়ুউড়ু বাতাবি বাতাসে, লেবুতলে থিতু কোনো ধ্যানমগ্ন বিকেল বেলায়, সামাজিক বানের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া একান্ত গচ্ছামি, হাম শরণং, বুদ্ধং... শব্দব্রহ্মাদি

নিসর্গ ব্যানার্জি

উলটোদিক থেকে নামতে গিয়ে অনিবার্য পতন ঠেকাতে পা ফেলানো শিখে গেছি আজ প্রাণান্ত কৌশলে, কেননা নামতে হবে, কোথাও উঠতে হলে পূর্বাবস্থান থেকে নামতে হয়, রংজেং-এর চূড়া থেকে বিরিশিরি ম্যালা পথ, দুর্গম ঢাল, হ্রদ এবং বুনো সন্ত্রাস, বৃক্ষবিরোধ পার হলে কিমিয়া সীমান্ত ফাঁড়ি, কাঁটাতার ও সোমেশ্বরীর অনন্ত বালি

শ্যাওলাবিব্রতিসহ সমস্ত ছাল-বাকল ছাড়িয়ে একটি নদীকে জাগাব, এহেন সিদ্ধান্তে দেখ পুনরুত্থানের মতো মাথা উঁচিয়েছি-- দুই পা আমার দুই ভুল কুমিরের মুখে, সতত নিচের দিকে টান, হাতির শক্তিতে তবু দুমড়ে-মুচড়ে যাব, মাহুতের প্রেমে তুমি শুঁড় ধর শুধু

যেতে যেতে বহুকাল গেছে, এ বেলায় জেনে নেই বাহারি সৌরভ, আনুপূর্ব ছুঁয়ে-ছেনে বুনোকুসুমের, দিনে দিনে না-হয় পরে তুরীয়ানন্দে যাওয়া যাবে, বেশি নয় একটিই দারুণ খায়েশ, কোনো এক আরণ্যসন্ধ্যায় ঠিকঠাক তোমাতে আরূঢ় হব, নিসর্গদি

তুলো

ও তুলো ওড়ো ওহে ভবঘুরে চিরদায়হীন, যেভাবে চলেছে উড়ে দুঃখঘুড়ি ওই মেয়েটার মনে, মেয়ে তো নয় মহিলা অথবা মহিলা-মেয়ে, ওর চতুর্থ বিয়ের কিছুতে ঠিক হচ্ছে না পাত্র, শারদউষ্মা মাখা উদাসী দুপুরে এই আঁচলবন্দি দুঃখ গুচ্ছ গুচ্ছ উড়িয়ে দিচ্ছে ও রে’নট্রিতলার বাতাসে, মনটা উড়ে যাচ্ছে ক্ষণে প্রথম স্বামীর কাছে, ক্ষণে দ্বিতীয়ে-তৃতীয়ে, আর মুখটা ছেয়ে যাচ্ছে সাদাসুখে, শরতাকাশের মতো সাদায়, কখনো কালোবিষাদ ওই কাকটার মতো কালোয়

ওদের ভুতুমগাছে এবার নাকি বেশ ভোমরা জমেছে, গেলকাল ধরেছে একটা তার, বাওয়ালি ছোকরা মানিককে উঠিয়ে, আঙটি গড়বে বলে সুদূর স্বামীর লাগি, পাথরের বদলে বুনো ভোমরার নীলচে পাখায়, ওদিকটা একবার গেলে দেখতি লণ্ঠনঘুড়ি, মাঞ্জার সুতা কেটে জিতে যেত মেয়েটার যান

ও তুলো ওড়ো ওহে শুভ্রশিমুল, উড়তে উড়তে কোনো সুদর্শনা মেঘের টিলায় গিয়ে জমা হও, যৌতুক সংকটে কাবু ওর বিয়েতে দেবার লাগি, অন্তত একজোড়া বালিশ বানিয়ে তো দেয়া যাবে

ষষ্ঠেন্দ্রিয়যোগে

প্রথম শিক্ষক হলো বেড়েওঠা আঁকশিটা, নানারূপ বেড়েওঠা পৃথিবীতে আচরিত, জনে জনে উদ্বোধিত নবীন নন্দন বোধ, প্রয়োজন হাতে হাতে বিধানপ্রণেতা

জন্ম ও জয়োৎসবে পিছুটান ভালো, ভালো সব প্রত্যাখ্যাতি, তবু বনপথে খিলান ধরে দাঁড়িয়ে ওঠা ডগা, কস্তুরি কসম ধায় আলোর সমীপে

আধশুষ্ক শিকড় প্রণীত স্মৃতি ও স্নায়ুতে, বহু অভিযোগ গালাগালসহ সঞ্চয় তন্দুরি নিয়ন্ত্রিছে দেহ, যেথা চাহিদার যোগানদারি করি নিজে

মানুষের শিক্ষার গুরুভাগই ষষ্ঠেন্দ্রিয়যোগে

দূরাধিক স্বপ্নকুয়াশাজাল

প্রায়াথর্ব শুয়ে আছি হাজার বছর তমোঘন রাতে, ধ্বনিত সৃজনোল্লাস জীবের শ্রোণিতে, সময় নিকটে এসে ভেঙে পড়ে জলীয় কণার মতো একা, তবু চোখের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে একখানি বেড়েওঠা ক্রমবর্ধমান, চেরাপুঞ্জির জঙ্গলে বাড়ে যেন জলোল্লাসী গাছ, পাখার ব্যঞ্জনাঘন এই সেই দূরাধিক চাওয়া, সৈকতে বালির প্রায় স্বচ্ছ অভিপ্রায়

সংসার বিষণ্নগাথা শ্রেয়োজল মাখা, কুসুমিত ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ যৌথ-অধিষ্ঠান, একটা একটা করে ভেতর-ইষ্টক খসে খসে অলংকৃত ফাটলে ফাটলে যেন পোড়োবাড়ি, ভেঙেচুরে দিনে দিনে ইতিহাস লিখে চলে বয়সের বলিরেখা জুড়ে, তার সিক্ত ক্ষতদেহে উদ্গত অঙ্কুর এক মহীরুহ প্রায়, আড়েদিঘে বেড়ে ওঠে নিতিদিন

নিচে তার প্রায়ান্ধ সাদা ঘাস, আলোসন্ধানে প্রস্থাপ্রস্থি কেবলই লম্বা হতে থাকি

আড্ডার বেঞ্চির কাছে

বাতাস আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেলে কার এমন দায় থাকে আঁচল উঁচিয়ে ফের ডেকে আনে, কার এমন নিজের বাঁচার চেয়ে অপরের মহিমা লাগি নিয়োজন বোধ আছে, কার এমন হাত ধরে বাতাসের ন্যালাখ্যাপা হাত, আড্ডার চেয়ে নিরুদ্দেশে আজ তবে ভালো, আজ তবে গাছের ছায়ায় বসে পাখিদের অফুরান চুলোচুলি দেখা, মলয় মর্মরে বাঁধা গানজলে ডুবে-ভেসে অমিত সিনান

শহরের অন্তরখানে আজ এত ঢেউ, দূর কোন সীমা থেকে বয়ে আসা প্রবাহনবীন, সহিংসতার ভারে নুয়ে পড়া সভ্যতা ঘ্রাণ, কারো-বা পতন কারো উত্থান সম্ভাবনা

সেই কোনো বায়ুপাখি আমাকে পালকে বেঁধে কোথাও উড়িয়ে যদি নেয়, যদি ধর্ষণে জর্জরিত জগৎকথার চেয়ে আরো কোনো গানজলে ধুয়ে দেয়, আড্ডার বেঞ্চি তোমার কী এমন ক্ষতি

পরকীয়া

অনাস্বাদিত অরণ্যা হরিণ খুঁজে গৃহপালিতের আমি খেয়েছি কামড়, শিঙের গুঁতায় বুঝি প্রেম প্রেম খেলাধুলা ভুলে যাই, ঘাসের আড়ালে থাকা তোমারই গোপনে আমি দৃষ্টি মেলাই, বুঝি সবুজের অধিক কিছু পৃথিবীতে নাই, আর বোধে এসে লেগে যায় আস্ত চাপড়

২.
শৃঙ্খল যে অংশটুকু পুড়ে দেয় দেহ ও মনের, বাইরে সে পোড়াবিন্দুগুলো জেগে উঠতে পারে এক নবানন্দভরে, মুক্তির এমনই গুণ অপরলীলায়, ঘর মাঠ একাকার, মাঠ ঘর রেখাকার, কিছুই যায় না চেনা, শহর কোনটা আর কোনটা যে গ্রাম

শত্রুজনোচিত

শীতের শবজির মতো লসলসে সময়ে কখনো বল নি যে ভালো থেকো, দারুণ খরায় বুক ফাটা যে কাল, তখনো তুমি মেঘমল্লারে নেই, বললে এসো দীপক রাগে ভাসি

প্রান্ত ছুঁয়ে থাকা

ডানে কর্ম না-ফুরাতে বামে ফুরায় জীবন, একজীবনে এই হা-হুতাশ সঙ্গী হয়ে র’লো, জল খেতে কষ বেয়ে একটুখানি পড়ে যায় নিচে, ও-ঘটন উপজাত, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, আর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজাত টেম্প ফাইলগুলোই সর্বদা বেশি জায়গা নিয়ে নেয়, সড়ক দুর্ঘটনা থেকে ভিআইপি সাইরেন, অন্ধকারে কামার্ত রব, বিড়ালচোখা রাত্রির আলো, শাখার প্রমত্ত টান, আরো কত কী যে

এসব বর্তমানের কাছে নাজেহাল হতে হতে কেবল অতীতই বর্তমান আছে এরূপ মানসাবস্থার একজনের কাছে মেলে স্বতন্ত্র জানালার সন্ধান, সে কেবল মাকড়সার জাল সরানোর মতো করে একটুখানি প্রান্ত ছুঁয়ে থাকা, বোটলব্রাশতলায়

‘না’জনিত একটা মাত্র বেদনা, ওকে আমলে নিয়ে বিকল্প খতিয়ে না-দেখা একধরনের দুঃখবিলাস, আর দুঃখ একদম সইতে পারে-না-জনরাই সেরা দুঃখবিলাসী হয়, একথা লেকের জলে পড়া সদাকম্পমান দুঃখী মুখচ্ছবিগুলোতে নাকি লেখা হয়ে আছে

অ্যাডজাস্ট করে নেয়াটাই আসলে বড়ো কথা, চিরকালীন, যারা সেটা পারে তারা ক্রমশই আরেকটু ভেতর দিকে হাঁটে, কখনো-সখনো তলা অব্দি কখনো-বা সারফেস জয় করে আসে, আর সহসা যাদের দফারফা, তারা থামে যারতারমতো

সম্বিত সবসময় একরকম থাকে না কারো, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে তাকাতে হয়, অথচ প্রতিটা বিষয়ের পিছনে এত বেশি বেদনামূর্ছনা লুকানো থাকে যে একটা মাত্র ডিটেলেই ফুরিয়ে যেতে পারে গোটা একটি জীবন

জিজ্ঞাসাচিহ্ন

একটা জিজ্ঞাসাচিহ্নের এমন ক্ষমতা আমি কখনো বুঝি নি আগে, প্রশ্নকম্পিত হতে এত ভয় যে স্বরূপটা বেরিয়ে আসে দ্রুত, এই বিষচোট সামলাতে না-পেরে ক্ষণবাকহারা কেউ নিজেকেই মনে করে ঘন-গোল-কুজা-- সদাশয় আরেকটি প্রশ্নের বিস্ময়, হায় লাইভ প্রশ্নেরা, কত-কে-কী, কোথায়-কখন-কেন ও কীভাবেগুলো

প্রশ্নত্ব ছাপিয়ে প্রশ্নের ভেতরে কেউ খুঁজে পেলে ব্যঙ্গভার, সরল জবাব থেকে সহজেই বেঁকে যেতে পারে পথ তীর্যকতার দিকে, কিছুটা আক্রোশে, ‘যারে দেখতে নারি’র চলন বাঁকার দিকে ব’য়ে দিতে ক্ষোভের প্রবাহ এক বর্জ্যবাহী প্রণালির মতো

মিছে ব্যঙ্গচ্ছবির ছায়ায় ঢাকা পড়া সম্পর্ক ও তার শিথিল বাতাবরণ, নীরব রক্তপাত, আয়ুষ্কালের নরম রজ্জু ছিঁড়ে পড়া স্বপ্নসম্ভব যাত্রার ভবিষ্যৎ আমরা মনে রাখি তবু, উত্তরহীন প্রশ্নার্ত পৃথিবীর হেলে পড়া ছবিটাকে দিগন্তরূপে চিরজীবন দিতে

হায় ধপাস, হায় প্রশ্নের নিচে চাপাপড়া আমাদের ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস-- একটা জবাব তবু খুঁড়ে আন দেখি, বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তির মতো ধসে যাওয়া সম্পর্কের ভগ্নস্তূপ থেকে

শূন্যে ও সরোবরে

খোলাকবরের সৌন্দর্যে যারা মাতোয়ারা আমার সন্দেহের কোনো শেষ নেই তাদেরকে ঘিরে, বস্তুত তারা মৃত্যুকে যমের মতো ভয় পান, এড়িয়ে চলেন-- অবশ্য নরকের প্রতি তাদের ফেসিনেশনকে আমি সমীহ করি, কারণ জগৎটাই-যে একটা তাপিত নরক, সেটা তারা জানেন এবং মানেন

আমি যখন শূন্যে ও সরোবরে বিবাহ প্রস্তাব করি, তখন তারা অপার সংশয়ে ডোবেন, মুততে মুততে জানতে চান, কেন আমি সরোবরের প্রতি অমন আত্মীয়তা অনুভব করি, বিপুল বেগযুক্ত হতে হতে আমি বলি-- এই গ্রহ জলের না-হলে আমার-আপনার জীবনই হতো না, বলি যে, দেখেন-না বিজ্ঞানীরা কেমন প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজতে আগে জল খোঁজেন গিয়ে মঙ্গলগ্রহে

কেউ একজন যখন সরোবরের সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিতে চান শূন্যের অঙ্গহানিসহ, তখন তারা অন্যদিকে তাকিয়ে হাসেন কিছুই না-বলে, যাতে সন্তুষ্টির সম্ভাবনাকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে দিতে পারে অসন্তুষ্টি থেকে আসা ভাঁপ, যাতে বিড়ালকে ঠিক বিড়ালরূপে না-চেনা যায় বনের প্রেক্ষিতে

অবশ্য একথা ভোলা সঙ্গত নয় যে, এরা হলেন দৃঢ়চেতাদের দারুণ বন্ধুজন-- দিনের এবং রাতের, জলের এবং ফলের

প্রক্ষালনের গান

এরপরও, জেনো আমরা হাঁটব বিস্তর, হাতে পায়ে এরপরও জল-হাওয়া ছুঁয়ে যাব, তেপান্তরের মাঠে সহসা পাতব কান বেজেওঠা সুরধ্বনিলয়ে, সসাগরা এ ধরাকে ভাবব জননী, পথে যেতে পাখিসমাগম খুব দেখা হবে আমাদের, দেখা হবে আনন্দরহিত প্রেম, খুনপনা, নিজের বিছানে শোয়া কুতকুতে লালাগ্রস্ত অচেনা বিড়াল

মানবস্বভাব বলে ইতিহাসে চুনকাম রদ করে এরপরও জেনো আমরা ভাবব অতীত, ইচ্ছারহিতভাবে দাঁড়িয়ে ভুলের পাশে শাসাব নিজেকে, কিছুই হবে না জানি, বিগত দিনের থেকে আবেগ কুড়িয়ে এনে রাতভর কাঁদব একাকী তবু, পতনদহন ভুলে দায়ী করে যাব শুধু নীতি-নৈতিকতা, পুবের দিগন্ত জুড়ে লালাভার দেখা পেলে ভারী গলে বলে যাব প্লুতকথারাজি-- হে আমার নিঃশব্দ প্রেম, এ ছিল একদিন আমাদের সুশালীন কামনার রঙ

বিড়ালটি

তোমরা চলে যাচ্ছ, ট্রাকে মালামাল উঠে গেছে সব, এক জীবনে মানুষের কতবার যে বাড়িবদল জরুরি হতে পারে মানুষও বুঝি তা জানে না

একদিন এভাবেই ট্রাকে মাল বোঝাই করে রেলিঙ ঘেরা এই বাড়ির একতলায় তোমরা নোঙর ফেলেছিলে-- অতিথি পাখি ও গৃহস্থ বিড়াল একদিন ভোরবেলা চার সদস্যের একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার দেখে আহ্লাদে উল্লাস করেছিল

তোমরা ত্যাগ করে যাচ্ছ একটি অভ্যস্ত পরিমণ্ডল, তার বিয়োগ ব্যথায় তুমি কাঁদলে তোমার মা কাঁদল, ট্রাকের সিটে গিয়ে বসলে সবাই, তুমি, তোমার মা, ছোট ভাই, কুমারী আত্মীয়া-- বাবাকে তো আগেই রেখে এসেছ অনিবার্য মাটির বিছানে

গাড়ি স্টার্ট নিতেই তাড়াতাড়ি হাত নাড়লে তোমরা সবাই, শেষবার তাকালে, বাড়িওয়ালা অনুভূতিহীন, তখনই টাঙিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটে ধরার ‘টু লেট’ বাহানা, ঘরে জল ঢেলে ধুয়েমুছে দেয়া হচ্ছে তোমাদের সুদীর্ঘ ছোঁয়া

সব মায়া কাটিয়ে বাধ্য হয়ে তোমরা শহরান্তরে যাচ্ছ, পেছনে কাজলা বিড়ালটি দৌড়াচ্ছে... দৌড়াচ্ছে... দৌ...ড়া...চ্ছে

ছুরি

জমাট রক্ত যেন, ডালে ডালে শিরা-উপশিরা জুড়ে পক্ক সম্ভাবনা, জগডম্বুর রাশি ঝুলে আছে থোকা থোকা লালপেড়ে বধূ, চাঁদের রুপালি রেণু প্রান্তর জুড়ে শ্বেতাম্বর বিছায়ে, মুখে রূপকথার রাজকন্যের রূপের বর্ণনাখানি ঝরাতেছিল আর পুবাকাশে মিলাতেছিল রঙধনুর রূপসী বর্ণালি সপ্তকিনী, পাশে গুঞ্জরে উঠছিল সসাগরা হাওয়ার ম্যান্ডোলিন

আর ধপাস করে কার এমন সন্ধ্যারাতে নাকফুল হারাল আমাকে জানাল না জোনাকালো ঝিঁঝিগান, চিবুকে হিংসা চেপে পাশ কেটে চলে গেল খরগোশ যুবা, চিনল না প্রণত পথের ঘাসও, যারা ভিজছিল জোছনা বৃষ্টিতে, চিনল না আকাশের সাপিনী-নাগিণী, প্রাণান্ত যুবক এক শুয়ে আছে বুকে বেঁধা সৌন্দর্যের ছুরি

ভয়বাহার

ভয় এক অনন্ত অনুগ, রূপের সওদা সব বয়ে নিয়ে ছায়ারূপ গৃহান্তরে ফেরে, সবকটি রুপার খিলান সোনার সিন্দুক তার আপনাধিকারে, আশ্চর্য চাবি নিয়ে অহোরাত্র মাতাল ভ্রমণ, গ্রাম এবং সুদূরের বন দুর্গম, জানালায় ফুরসত পেলে সে, রমণীয় যেকোনো দৃশ্যগান দু’চোখে কেড়ে নিতে ছাড়ে না

মৃত্যুর শিয়রে ছিল এক আঁজলা পানি, সব তার শুষে নিয়ে বাঁদিকে তাকানো তবু পুব বলে, পূর্বে আকাশ নবীন, আপনিই ফুটে যেথা চতুর কুমারী তারা, চুল বাঁধা গোলাকার লাল নাইটি পরা অনন্ত যৌবনা, এদের ব্যাপারে সাবধান হতে কৈশোরেই জানিয়েছিলেন অধিবিদ্যক গনতকার একজন, বিশ্বাসী না-হওয়ায় বারেবারে দেখি আমি সে ফাঁদেই পা রেখে চুপে কাত হয়ে আছি

২.
পয়মন্ত গাভির বাঁটের কাছে মমতার ঝাঁপি রেখে গোল্লাছুট খেলবার দিনে আমি যাদের বাঁ’হাত ধরে শিববাড়ির মেলা দেখাতে নিয়ে গেছি তিন গাঁ পরে, তারা এখন দূরের মাঠে রাখালি বাঁশির সুরে বেদনা ছড়িয়ে দেয় অশ্বত্থের ডালে বসা পরিযায়ী পাখিদের দেশে, আর সন্ধ্যায় মেলায় পা ফেরত গরুর পালের সাথে, পরগৃহে

৩.
রাত্রির আঁচল চিড়ে এল খাকিজোড়া, বলে হল্ট, হাত তোল ব্যাটা, নিশির গায়েতে দিলি হাত, চল তোকে তুলে দেই সুনীল লকারে, আঁধারের জামা গায়ে কেন ঘোরাফেরা, ঘুম র’লো সুখ র’লো, ঘরে পড়ে র’লো তোর যাবতীয়, বউ-ছেলে, বল দেখি কে যোগাবে খোরপোশ– আমি রাত্রিপুলিশ, যখন যা ইচ্ছে করে, তাই করে থাকি

৪.
আত্মা পলিথিনের মতো– পাখিআত্মা, গলে না পচে না, বিশাল এক অ্যাকুরেমে উড়ে গিয়ে মাছ হয়ে সাঁতরায়

অ্যাকুরেমে রুমভেদ নেই, নেই প্রাইভেসি, আমি গেলে ওখানেই দেখা হবে তোর সাথে, জলকেলি হবে খুব খোলামেলা, সবার সামনেই

এহেন মূর্ছিত বেদনায়

মাকড়সার দেহের মতো খুবলে দিতে চারপাশ থেকে ধেয়ে আসছে তীরতীব্র লেলিহান জেদ, নোখের আঁচড়ে বোধের বাটিক করা গাত্রাবরণী জুড়ে লেগে যাচ্ছে সার সার ঈর্ষার দাগ

সমূহ শঙ্কায় বিশদ লাঞ্ছনা থেকে বেঁচে যেতে, ভেষজ পদ্ধতি খুঁজে পাহাড়ের দিকে হিজরত করেছি বহুবার, পথে যে কটি বাঁদরের সাথে দেখা, সকলে বলেছে যে গাছের পৃথিবীতে পলায়ন যথাকর্ম নয়, গাছের সহনমতা মানুষের হলে লোকালয়ই হতে পারে নিরাপদ বসবাস স্থান

অন্তরালবর্তী যেসব চাওয়া কচ্ছপের গলার মতো লাজনম্রতায় প্রাথমিক স্কুলের মাঠে শিশুসুলভ হৈচৈ করে যাচ্ছে এবং দিন দিন একই ক্লাসে থেকে যাচ্ছে আদুভাই, নিয়ত বিঘ্নিত হচ্ছে যেখানে সঘন উন্মোচন, জনৈক বাঁশিওয়ালা হুটহাট ঢুকে গিয়ে সবাইকে সাবালক করে দিলে এইসব তীরের উৎপাত লোপ পেয়ে যেতে কতদিন থাকবে বাকি

ততদিনও, ছাগলের পৃথিবীতে কাঁঠালগাছ হয়ে পাতাহীন বেঁচে থাকা দারুণ শোকের, আমি বুঝে গেছি

আহা এই সাঁড়াশি জীবন

‘ও’কার সংক্রান্ত জটিলতা শীত ঋতুতেও যদি দেহে ঘাম আনে, মেনে নিতে হয়, এ জট এমনি কুটিল জট, ছাড়াতে ছাড়াতে শত ফোস্কা পড়ে হাতে, বডিমাস্ক পরেও এর পারি নি দহন জ্বালার থেকে বেঁচে যেতে

দেহে বরফ জড়িয়ে থাকে যারা, মনোত্তাপের রেখা হিমাঙ্কেরও নিচে যাদের, তারা শুধু মুক্ত এই অকারণ জটিলতা থেকে, বরফবিকার হলে আগুন কেমন করে সাড়া দেয়, এ তথ্য আমাদের কমবেশি জানা, যদিও জানি না সেটা লকলকে নাকি ঠিক সুচালিত লোহিত-কিম্ভূতে

আমাদের বস্ত্রব্যবস্থা নিয়ে বিশেষ ভাবিত যারা, শ্রমের শোষক সেই জোঁককুল, না-সৃজিয়া স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ, সস্তায় রাশিরাশি মেয়ে কেনে শুধু, মাঠে মাঠে বাড়াতে বলে কার্পাসের চাষ, ভেড়ার লোমের প্রতি হতে বলে অতি যত্নবান, রপ্তানিমুখী উলের ব্যঞ্জনা যাতে ফুলে-ফেঁপে ওঠে সব অন্দরে-বন্দরে, এজন্য আছে ঢের প্রেষণাকার্যও

তুলা ও লোমের প্রতি প্রেমাতিশয্যে নয়, আমাদের ঘরে ঘরে বস্ত্রকর্মী তবু, গায়ে গায়ে বস্ত্র না-হলেও, আমাদের উম আসে বিবিধার্থ জটিলতা থেকে, এমনকি প্রায়শ-লাগা কারখানার মানুষপোড়া আগুনেরও থেকে

কথারণ

সাদা পাতার সাথে বন্ধুত্ব যত গাঢ় হয় হাতে ও পাতে তত কালি লাগে, এহেন বন্ধুতার আশায় সাদা পাতা সামনে নিয়ে বসে থেকে কাটে মহাকাল, আঙুলে আঙুলে জমে প্রসব বেদনা

স্ফূর্তিগুলো কোনখানে যে থাকে, ঘুরিয়ে মুখ অন্য কোনোদিকে, আমি তারে খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে রণেভঙ্গ দেই, তবে ঠিক পালাবার কালে যার সাথে দেখা আর কথা হয়, সেটাও এক রণেরই সমতুল মুখে মুখে, অথচ কথায় জিততে গেলে যে অস্ত্র লাগে সে অস্ত্রে যথাতথা শান দেয়া চলে না হে, ভোঁতা অস্ত্রে যুদ্ধ করে সাদা পাতার দিকে ফিরে দেখি, সবখানে লেগে গেছে রক্ত ও মরিচার দাগ

দ্রুত খুব, সাদা পাতা উলটে খানিক মান রা করি, আর যাওয়া মান ফিরে না-পাওয়ার কথা লোকমুখে বহুবার শোনা হয়ে গেছে, আশাতরী ডুবে না তখনো বড়ো, নাছোড়ামি, এটা ওই জীবনেরই তরে

সেতু

একই ভেলায় চড়ে পাড়ান্তরে যাচ্ছি আমি আর ইরা, ইরাবতী– ওপারে মৃত্যুর তীর, এলিয়ে পড়া কেশের বহুলতা ঢেকে থাকা মরণসুষমা, তার মহিমাকে ছুঁতে যাবার সঘন আর্তি কণ্ঠে মেখে আমি বলি– পারাপারলঘু এই দিন ও রাত্রির চিত আনন্দ কল্লোলগুলো গায়ে মেখে যাব, তানপুরাটা আয়েশে ধরে রেখো তুমি ঈষৎ হেলিয়ে, নিহিত আঙুল এসে অদৃশ্যে বাজিয়ে যাবে আনন্দলহরি, অবশ্যএষণা

পোলকা ডটের মতো চোখ তুলে আকাশের দিকে, বলে ইরাবতী– জলের গল্প কেবল তখনই ভালো লাগে, শুষ্ক মৌসুমে, খেলানো উচ্ছ্বাসগুলো পলকে মিলিয়ে গেলে দূর সমুদ্রপাড়ায়– তবু, ফেনাময় ঢেউয়ের রেখা যদি মূর্ত হয়ে ওঠে কোনোখানে, ভেসে যেতে পারব না আমি ললিত প্যাশনে

একই ভেলায় চড়ে তুরীয়ানন্দের দিকে আমাদের যাত্রা শুরু অনিবার্য বিভূতি বোধনে

মোহিনীবিলাপগুলি

বদ্ধজল পেছনে রেখে স্রোতস্বিনীর দিকে হাঁটা দিলে মুখ ভার করে থাকে যারা, তাদের জন্যে কোনো মায়া আর অবশিষ্ট নেই বলে পেছনে তাকানোটুকু ভুলে গেছি, এত যে রতিবাঁক ঠাক ও ঠমক যুবা ঘূর্ণি অকূলে, লাফিয়ে ওঠা স্রোতের লতানো দেহে খেলে যাওয়া রৌদ্রশৃঙ্গারগুলো চিকচিক করে ওঠে, শিকলের ঝনৎকার শুনে শুনে কত আর সম্ভাবনার শুধু গলা টিপে যাব, গতির বয়স সবে শুরু হলো, এই তো শিখছি সবে শরীরের ডানবাম, চোখের উপর-নিচগুলো

আঁখিপর্দার ওপারে যে গোলকধাঁধা নড়ন্ত স্রোতের গান বুনে যায় ঢেউয়ে ঢেউয়ে, ঊর্ধ্বে তা বিপুল এক গতি ধরে আছে, নোনা সে দ্বীপের শেষে জেগেওঠা সমীরের পালে চড়ে ফিরে, খুঁজে চারুনাবিকের হারা দিশা

নয়ন নেই আর কোনো নয়নের স্থলে, সময়ে অনেকটুকু নড়ে গেছে, গতির চিবুক ছোঁয়া সেয়ানা মোহিনী ঘোর বস্তুসভ্যতার, আমরা কি সবে বহন করে যাচ্ছি না তার দীর্ঘ ও বিস্তৃত লেজের দম্ভভার, তবু অনড় পণের চোখে থুথু ছুড়ে ক্ষণ-ও-পল-কে গুণে পথে নামা জেনো, মোহিনীবিলাপগুলো ভুলে যেতে একদিন দরকারি মনে হবে

বক্ষগ্রহপুঞ্জে

এইসব পাথরপ্রবর আমি রাখব কোথায়, পরিসর ছোট হয়ে যদি আসে দিন দিন নিখিল বুকের, এইসব ক্ষতের বেদনা আমি ঘুচাব কেমনে, পাঁজরবাঁশিতে যদি বেজে চলে নিত্য হাহারব

নবীনা ইচ্ছেরা যেন ডুবিগাঁও, ভাসা-- তার মেঠোপথ, উতলা বনের শিস, চতুষ্পাঠী বেলা

বক্ষগ্রহপুঞ্জে ক্রমে জাগিতেছে যতিবন, অবদমনের ঢের জলা

হা-য়ের দিকে ফেরা

হাওয়া খেতে খেতে একযুগ অপেক্ষার পর বাহারি বৃষ্টিরাতে ফিরছি একাকী, নদীতে হাত নাড়ে আকাশের গাছে ফোটা সুকুমারী ফল, ও-আমার একাকাল যাপিত সময়, স্বপ্ন-প্রেম বিস্মৃতায়ন, আর খুঁজে পাওয়া নিজেকে নিজেই

ফিরছি ফেরা ভালো বলে, সাপ-ব্যাঙ সকলেই ফেরে এ-বিধ সংসারজালে

বোধকরি ওই পরাহ্ণউচ্ছ্বাসই ভালো ছিল গতায়ু যুগের, সাথে রাজ্যের যত অতীত, ঘুরেফিরে শোনা, চিড়িয়াখানার মতো ঘুরেফিরে ঘুরে ফিরে…
চিড়িয়াখানায় কোনো অজগর ছিল না সেবার, জলহস্তি ছিল না, অজগরের অধিক এক বিশাল হা-য়ের দিকে এবারই প্রথম ফিরি

আমার করুণ ছায়া

হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাচ্ছিল স্বাচ্ছন্দ্যখানি কাচের পাত্রের মতো, তার একখণ্ড তুলে এনে তোমার করতলে রাখি, কয়েকখণ্ড পকেটে পুরি ও পায়ে পায়ে রক্ত ঝরিয়ে অবশিষ্টের গায়ের উপর দিয়ে হেঁটে যাই বিষণ্ন বদনে

জেনে রাখ, বিষাদের বোঝা বয়ে যেতে বড়ো শহরের এক থেকে আরেক স্থানের দূরত্ব এত বেশি লাগে যে, হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, যা বয়ে বেড়াচ্ছি তার ভার নিজের দ্বিগুণ

ছড়িয়ে থাকা সবটা আমাকে তোমার হাতে তুলে দিতে কখনো পারব না জেনে এখন ছড়িয়ে পড়ার বিরুদ্ধে ক্রমে দৃঢ় করছি মন, বাতাসকে জানিয়ে দিয়েছি উলটো প্রস্তাব, দিকে দিকে ছড়িয়েছে যেটুকু আমাকে, দ্রুত ফের সবটা আমাকে যেন একখানে জড়ো করে রাখে

তোমার হাতে রয়েছি যেটুকু আমি, আমার পকেটে আমি আছি যতটা, একদিন মনে হবে এটুকুই আমি, বাকি কিছু আমি নই, আমার করুণ ছায়া

বেঁচে থাকার সাথে

বেঁচে থাকার এক পর্যায়ে মধ্যদুপুরে মৃত্যুর সাথে মুখোমুখি দেখা, সে তখন বসা ছিল বাড়ির পালানে একা, বেঁচে থাকা পদব্রজে একাকী সে পথ দিয়ে যায় দু’য়ের মধ্যিখানে দূরত্ব ছিল মাত্র বিঘত কয়েক, প্রতিবেশীর মতো দশাসই কুশল ও দৃষ্টি বিনিময় হলে পরস্পরে, ফিরে গিয়ে এই যা নির্ঘাৎ হস্তমৈথুনে মাতে বেপরোয়া বেঁচে থাকা, কেননা সম্পর্কের এ পর্যায় গিজগিজ করে যত গুরুতর অনু ও শাসনে, তাতে ভাত খেলে চলেই না যেন জল, জল খেলে কফি, যত হোক চেনাজানা, আমরা কেননা ঠিক গ্রহণ করি না মৃত্যুকে সহজে, দা ও কুমড়ার মতো হয়েও বেঁচে থাকার সাথে মুহূর্তে শুয়ে পড়ি এক বিছানায় অপরাহ্ণের হালকা রোদে তিসি খেতের আলে বসে জেদি কুকুরের মতো তারপর ক্রমাগত লালা ঝরাতে দেখা যায় মৃত্যুকে, চোখে তখন তার হলকা ছিল এক আগুনের, যে আগুন বেঁচে থাকা কখনো দেখে নি আগে

জীবন-উনুন

স্যার আমি বলি জীবনের রঙ লাল, উনুনের সাথে যার সম্পর্কটা স্পষ্টতর অতি, আর লালাগুন উনুনের মুখ্য উপাদান

প্রতিজন মানুষের পেটের ভেতরে কম করেও একটি উনুন থাকে, থেকে যেতে পারে, পেটের ভেতরে তাই লাল না-হলেও ঈষৎ কমলা অগ্নিভাণ্ড রয়ে যায়, উনুনসূত্র রচনা থেকে শুরু করে মানুষের যত নড়নচড়ন, এটা-সেটা কাজের প্রকোপ, সেটা মাত্র অগ্নিজাতোত্তাপে

মানুষে মানুষে বিরাজিত শাস্ত্রভেদ– মানুষের রাজনীতি-অর্থনীতি-নন্দন-দর্শন, পরস্পরে হিংসা-দ্বেষ-রেষারেষি, কাউকে টপকে কারো-বা সামনে গিয়ে বসা, প্রত্যক্ষে অথবা পরোক্ষে সব নিয়ন্ত্রণ করে পেটের ওই অদৃশ্য অগ্নিরাশি

স্যার আপনি মানুন আর না-মানুন, জীবনের রঙ উনুনের মতো লাল, আর মানুষের পেটের ভেতরে এক লালুনুন থাকে

নাতিদীর্ঘ ভ্রমণ শেষে

যাপনের যৎপরোনাস্তি ক্লেদ, আত্মহননেচ্ছার প্রখর যৌক্তিকতা, উত্থিত লিঙ্গের নীরব ক্রন্দন ও বিরল প্রাণীদের বিচিত্র কেশপাশ থেকে বেরিয়ে আসা গন্ধোৎফুল্ল বাতাসে বিলি কেটে, একটি আমূল ভরা চুলঅব্দি টইটই, না-সফল না-ব্যর্থ জীবনের গল্পের ভেতর দিয়ে, মাত্র সোয়া চারশ’ মাস দীর্ঘ একটি ভ্রমণ শেষে, চেয়ারে বসেই আমি হাঁপাচ্ছি দারুণ

জীবনে যত হেসেছি-কুঁদেছি তার অধিকাংশকেই আজ মনে হচ্ছে খুব অশ্লীল, মনে হচ্ছে শ্লীল ছিল না স্ত্রীর সাথে করা অনেকানেক বৈধ সঙ্গমক্রিয়াও

এরই মধ্যে আমি জেনে গেছি তুলনার অর্থহীনতা এবং অকপটতার সৌন্দর্য বিষয়ে কোনো সংশয় থাকা একদম ঠিক নয়–- জেনেছি যে ভান যত সফিসটিকেটেড আর্তিই হোক তাকে ঘেন্না করা ভালো, আর ত্রিশোত্তরে নিজ আচরণে বড়োসড়ো কোনো চেঞ্জ রপ্তকরণ-চেষ্টার চেয়ে ভুলকর্ম দ্বিতীয়টি নেই

এই সবই সতর্ক অর্জন, সবই এর কুড়িয়ে পেয়েছি আমি জীবনের পথে, তাকিয়ে সিংহাবলোকনন্যায় জাগতিক জেনে গেছি আরো বহু কিছু, পৃথিবীতে মন্দির-মসজিদ-গির্জা-প্যাগোডা যত, সমুদয় বিলোপ করে সাজানো গেলে সেথা ফুলের বাগান, নিত্য হানাহানি ঢের কমে যেতে পারে বলে মনে হয়

শ্মশানগাথা

একটা মানুষ কীভাবে তার চর্বিসমেত পুড়ে ভস্ম হয়ে যায় তুমি না-দেখলে আন্দাজই করতে পারবে না গো দিদিমণি, মুখাগ্নিকাল থেকে ঘণ্টাতিনের মাঝে ক্রমশ এটা থাকে না ওটা থাকে না, শেষে কিছুই থাকে না তার

অবশ্য ‘কিছুই থাকে না’ না-বলে বলা যায় বাতাসেচ্ছায় মানুষটা ছড়িয়ে পড়ে কাছাকাছি গোটা দেশময়, এক হয়ে ওঠে বহু, ভেবেও দেখেছি আমি এরকম হতে পারে, মৃতের যে বিছানা ছিল, তাতে গিয়ে পড়তে পারে এক টুকরো ছাই, জায়া বা পতির হাতে সাজানো অর্ঘ্যপাতে অল্পখানিক, প্রথম প্রেমিকার খোলা চোখে কিছু, বাতাসে পাখা মেলে কতই তো এটা-সেটা ওড়ে

তাই বলি লতাদি গো, পুড়তে না-দেখলে তুমি বুঝতেই পারবে না যে শ্মশানের পোড়া ঠিক কেমনতর পোড়া, আর বুঝে কী না-বুঝে তুমি ক্রমাগত ঠেলছ আমাকে ওই শ্মশানেরই দিকে

ওয়েবগ্রুপ

Google Groups
কবিতাকথা
Visit this group